গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে অনেক পরিবর্তন ঘটে এবং একটি বড় আনন্দের মুহূর্ত হলো যখন প্রথমবারের মতো বাচ্চার হৃদস্পন্দন শোনা যায়। এটি শুধু একটি অনুভূতির বিষয় নয়, বরং বাচ্চার সুস্থতা ও বিকাশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে বাচ্চার হার্টবিট আসার সময়, লক্ষণ এবং বিভিন্ন পর্যায়ে কীভাবে এটি নির্ধারণ করা হয় তা জানা মায়েদের জন্য অত্যন্ত দরকারি। এই আর্টিকেলে আমরা গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিটের আসার লক্ষণ, এর সময়কাল এবং মায়েদের জন্য এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বিস্তারিত আলোচনা করবো।
গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হৃদপিণ্ডের বিকাশ
বাচ্চার হৃদপিণ্ড গঠনের প্রক্রিয়া গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়েই শুরু হয়। গর্ভধারণের ৩য় সপ্তাহে বাচ্চার হৃদপিণ্ডের গঠন শুরু হয়। এই সময়ে, হৃদপিণ্ডের কোষগুলো দ্রুত বিভাজন এবং বৃদ্ধি করতে থাকে।
৪র্থ সপ্তাহে, হৃদপিণ্ড একটি নলাকার গঠন হিসেবে উপস্থিত হয় এবং এটিই ক্রমশ একটি পূর্ণাঙ্গ হৃদপিণ্ডে রূপান্তরিত হয়। গর্ভাবস্থার ৫ম সপ্তাহের দিকে প্রথমবারের মতো বাচ্চার হৃদস্পন্দন শুরু হয়, যদিও তখন এটি খুব মৃদু এবং ডপলার বা আল্ট্রাসাউন্ড ছাড়া শোনা সম্ভব হয় না।
গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট আসার লক্ষণ
গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট আসার লক্ষণসমূহ
বাচ্চার হৃদস্পন্দন আসার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের শরীরে কিছু পরিবর্তন দেখা দিতে পারে, যদিও এগুলো সরাসরি হৃদস্পন্দনের সাথে সম্পর্কিত নয়, তবে এগুলো ইঙ্গিত দেয় যে গর্ভাবস্থা সঠিকভাবে এগোচ্ছে। নিচে গর্ভাবস্থার বিভিন্ন লক্ষণ তুলে ধরা হলো:
১. প্রাতঃকালীন অসুস্থতা (Morning Sickness)
প্রায়শই গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে মায়েরা বমি বমি ভাব বা প্রাতঃকালীন অসুস্থতার সম্মুখীন হন। এটি গর্ভাবস্থার একটি সাধারণ লক্ষণ এবং সাধারণত এটি বাচ্চার হৃদস্পন্দন শুরু হওয়ার সময়কালে ঘটে। যদিও এটি সরাসরি হৃদস্পন্দনের সাথে সম্পর্কিত নয়, তবে এটি গর্ভাবস্থার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়।
২. ক্লান্তি এবং শক্তি হ্রাস
গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে মায়েরা অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন। এটি হরমোন পরিবর্তনের কারণে ঘটে এবং হৃদপিণ্ডের গঠন ও হার্টবিট শুরু হওয়ার সময়কালে এটি বাড়তে পারে। মায়ের শরীর গর্ভের শিশুর জন্য পর্যাপ্ত শক্তি সরবরাহ করতে থাকে, ফলে মায়ের মধ্যে ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
৩. স্তনের সংবেদনশীলতা
বাচ্চার হৃদস্পন্দন আসার সময় হরমোনের কারণে মায়ের স্তনে সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। স্তন ভারী লাগতে পারে বা সেখানে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এটি হরমোনজনিত একটি স্বাভাবিক পরিবর্তন এবং গর্ভাবস্থার অগ্রগতির একটি ইঙ্গিত হতে পারে।
৪. আল্ট্রাসাউন্ডে হৃদস্পন্দনের সনাক্তকরণ
গর্ভধারণের ৬ষ্ঠ সপ্তাহ থেকে প্রথমবারের মতো বাচ্চার হৃদস্পন্দন আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে সনাক্ত করা সম্ভব হয়। এই সময়ে শিশুটির হার্টবিট বেশ মৃদু হয় এবং ডপলার প্রযুক্তির সাহায্যে তা শোনা যায়। আল্ট্রাসাউন্ডে বাচ্চার হার্টবিট শোনা মানে গর্ভাবস্থা সঠিকভাবে এগোচ্ছে।
৫. মায়ের শরীরে হালকা স্পন্দন বা নড়াচড়া অনুভব করা
গর্ভাবস্থার ১৬ থেকে ২৫ সপ্তাহের মধ্যে অনেক মায়েরা গর্ভের শিশুর নড়াচড়া বা স্পন্দন অনুভব করতে পারেন। যদিও এটি সরাসরি বাচ্চার হৃদস্পন্দনের সাথে সম্পর্কিত নয়, তবে এটি তার সঠিক বিকাশের লক্ষণ। এই নড়াচড়া এবং ফ্লুটার অনুভূতি মায়েদের আরও আশ্বস্ত করে যে শিশুটি সুস্থভাবে বেড়ে উঠছে।
বাচ্চার হার্টবিট না শোনা গেলে কী করবেন?
গর্ভাবস্থায় অনেক সময় বাচ্চার হার্টবিট দেরিতে শোনা যেতে পারে। এটি গর্ভের বিভিন্ন অবস্থা বা অবস্থান অনুযায়ী হতে পারে। এমন কিছু কারণ রয়েছে যার ফলে শিশুর হার্টবিট পাওয়া না যেতে পারে, যেমন:
১. গর্ভধারণের ভুল হিসাব
গর্ভধারণের সঠিক সময় নির্ধারণ করা না হলে, আল্ট্রাসাউন্ডে হার্টবিট পাওয়া নাও যেতে পারে। অনেক সময় গর্ভাবস্থার সঠিক সময় নির্ধারণ করা না গেলে, হার্টবিট পাওয়া দেরি হতে পারে।
২. প্রাথমিক আল্ট্রাসাউন্ড
যদি খুব প্রাথমিক সময়ে আল্ট্রাসাউন্ড করা হয়, তবে বাচ্চার হৃদস্পন্দন যথেষ্ট শক্তিশালী না হওয়ার কারণে সেটি ধরা পড়তে পারে না। প্রায় ৬ষ্ঠ সপ্তাহের আগে এটি সনাক্ত করা কঠিন হতে পারে।
৩. প্ল্যাসেন্টার অবস্থান
প্ল্যাসেন্টার অবস্থান যদি এমন জায়গায় থাকে যা শিশুর হার্টবিটকে ঢেকে রাখে, তাহলে সেটি সনাক্ত করা কঠিন হতে পারে। এই ধরনের অবস্থায় ডপলার বা আরও উন্নত আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুনরায় পরীক্ষা করতে হতে পারে।
৪. যমজ গর্ভাবস্থা
যমজ গর্ভাবস্থায় এক বা একাধিক শিশুর হৃদস্পন্দন সনাক্ত করতে সমস্যা হতে পারে। যমজ শিশুর ক্ষেত্রে অনেক সময় একটি হৃদস্পন্দন ঢেকে যেতে পারে। এজন্য সঠিক পরীক্ষার মাধ্যমে তা সনাক্ত করা যায়।
বাচ্চার হার্টবিট পর্যবেক্ষণের জন্য প্রযুক্তি ও পদ্ধতি
গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট পর্যবেক্ষণের জন্য কিছু বিশেষ প্রযুক্তি এবং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এ প্রযুক্তি এবং পদ্ধতিগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. ডপলার ফেটাল মনিটর
ডপলার ফেটাল মনিটর একটি সাধারণ পদ্ধতি যা গর্ভের শিশুর হার্টবিট পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয়। এই ডিভাইসটি মায়ের পেটের ওপর একটি ছোট যন্ত্রের মাধ্যমে হার্টবিট শনাক্ত করে। গর্ভাবস্থার ১০ম থেকে ১২ম সপ্তাহে এটি ব্যবহার করা যায় এবং এটি সহজেই হার্টবিটের গতি সনাক্ত করতে পারে।
২. আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান
গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যানের মাধ্যমে শিশুর হার্টবিট পর্যবেক্ষণ করা হয়। সাধারণত, ৬ষ্ঠ সপ্তাহের পর থেকে প্রথম হার্টবিট শোনা যায়। এছাড়াও, গর্ভাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে আল্ট্রাসাউন্ড করে চিকিৎসক শিশুর স্বাস্থ্যের অবস্থা মূল্যায়ন করেন।
৩. ইলেকট্রনিক ফেটাল মনিটরিং (EFM)
গর্ভাবস্থার শেষের দিকে এবং ডেলিভারির সময় ইলেকট্রনিক ফেটাল মনিটরিং (EFM) ব্যবহার করে শিশুর হৃদস্পন্দন পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে মায়ের পেটে ইলেকট্রোড যুক্ত করে হার্টবিট মাপা হয়, যা শিশুর সুস্থতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
বাচ্চার হার্টবিটের গতি: স্বাভাবিক রেঞ্জ
গর্ভাবস্থার সময় শিশুর হার্টবিটের স্বাভাবিক গতি থাকে। সাধারণত, শিশুর হার্টবিটের গতি গর্ভাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তিত হয়। ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম সপ্তাহের মধ্যে, হার্টবিটের গতি প্রতি মিনিটে প্রায় ৯০-১১০ থাকে এবং ৯ম থেকে ১২ম সপ্তাহে এটি বৃদ্ধি পেয়ে ১৪০-১৭০ পর্যন্ত হতে পারে। তবে, গর্ভাবস্থার শেষের দিকে হার্টবিটের গতি কিছুটা কমে গিয়ে প্রতি মিনিটে ১২০-১৬০ স্পন্দনের মধ্যে থাকে।
বাচ্চার হার্টবিট না পাওয়ার উদ্বেগ
যদি গর্ভাবস্থার নির্দিষ্ট সময়ে বাচ্চার হার্টবিট শোনা না যায়, তা হলে মায়েরা উদ্বিগ্ন হতে পারেন। তবে অনেক সময় বাচ্চার বৃদ্ধি একটু ধীরগতিতে হতে পারে বা গর্ভের শিশুর অবস্থান এমন হতে পারে যে, হার্টবিট সহজে ধরা পড়ছে না। এ ক্ষেত্রে, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আল্ট্রাসাউন্ড বা ডপলার মনিটরের মাধ্যমে পুনরায় পরীক্ষা করানো উচিত।
উপসংহার – গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট আসার লক্ষণ
গর্ভাবস্থার সময় শিশুর হৃদস্পন্দন শোনা মায়েদের জন্য এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। এটি শুধু একটি শারীরিক লক্ষণ নয়, বরং এটি বাচ্চার সুস্থ ও সঠিক বিকাশের প্রমাণ দেয়। গর্ভাবস্থার সময় শিশুর হার্টবিট পর্যবেক্ষণ করতে এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে, যাতে মায়ের এবং শিশুর উভয়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে। এরকম বিষয় বস্তু নিয়ে আমাদের ওয়েব সাইটে আরো অনেক আর্টিকেল আছে। চাইলে আপনারা পড়তে পারেন। আমাদের গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট আসার লক্ষণ আর্টিকেলটি ভালো লেগে থাকলে সবার সাথে শেয়ার করুন।আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন। ধন্যবাদ।